টুকটুকের সুখ দুখ


- আম্মু, আম্মু। ভাইয়া আমাকে খেতে দিচ্ছে না। ও একাই সব খেয়ে ফেলছে...
- আচ্ছা, আমি তোমাকে অন্য পোকা খুঁেজ দিচ্ছি। ছয় নাম্বার ছানাকে একটা পোকা খুঁজে দেয় মা মুরগীটা। এমন সময় অষ্টম ছানাটা এসে বলে, আম্মু আমাকে কিছু খেতে দাও। দিচ্ছি মা, এই বলে অন্য একটা পোকা খুঁেজ দেয় তার ছানাটাকে।
এভাবে প্রতিদিন বাচ্চাদের খাবার নিয়ে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয় মা মুরগীটার। তবে আজকাল আর ঝামেলা মনে হয় না। একসময় খুব ঝামেলা মনে হতো। তাছাড়া বয়স তো কম হয়নি। তিন বছর হতে চললো। অভিজ্ঞতা বলে একটা কথা আছে। এতোদিনে নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছে মা মুরগীটার। এ পযর্ন্ত কম হলেও শ’খানেক বাচ্চার মা হয়েেেছ। ডিম অনেকগুলোই পেড়েছে। সংখ্যা সঠিক মনে নেই। কত বাচ্চা যে হিংস্র পাখি বা প্রানীর কবলে পড়েছে তার ইয়ত্ত্বা নেই। তাছাড়া নানারকম রোগ-ব্যাধি তো রয়েছেই। ছোট্ট একটা বেগুন গাছের নিচে বাচ্চাগুলোকে আড়াল করে এসবই ভাবছে মা মুরগীটা।
আবার একটু দেখে নিলো মা মুরগীটা। দেখলো, মোট নয়টি বাচ্চা রয়েছে এখন। বাচ্চাগুলোর বয়স ২৫ দিনের বেশি নয়। তাই তার সর্তক থাকতে হয় একটু বেশিই। নিজেকে রক্ষা করার মতো কৌশল শিখতে পারেনি বাচ্চাগুলো। কৌশল শিখবে কি? এখনো তো ভালো করে নিজের খাবার খুঁজে পায় না। বাচ্চার কথা ভাবতে ভাবতে নিজের শৈশবের কথাও মনে পড়ে যায়। ওরা ছিলো ১৫ ভাই-বোন। বড় হতে হতে আট জন বাকি ছিলো। এর মধ্যে টুকটুকও ছিলো। তারপর যখন মোটামুটি বড় হলো তখন তার মার সাথে আর তাদের থাকতে দেওয়া হলো না। একই খোঁয়াড়ে ওরা আট ভাই-বোন একসাথে থাকতো। মা ততদিনে অন্য কতগুলো বাচ্চা জুটিয়ে নিয়েছে।
ওরা ছিলো আট ভাই-বোন। তিন ভাই আর পাঁচ বোন। বোনগুলো এখন কোথায় থাকে জানেনা টুকটুক। খুব কষ্ট হয়। মানুষগুলো বড়ই স্বার্থপর। ওর তিনটি ভাইকেই বাজারে বেঁচে দিয়েছে বাড়ির মালিক জরিমন বিবি। তারপর তার ভাইগুলোর কি হয়েছে জানে না টুকটুক। জরিমন বিবির ছোট মেয়ে কুলসুম অবশ্য খুব কেঁদেছিলো। মায়া মহব্বতে ভরা মেয়েটার হৃদয়। ওকেই ভালো লাগে টুকটুকের। কেবল কুলসুমই একটু মানুষ হতে পেরেছে। অন্য ভাইবোনগুলো মোটেও মানুষ না। কেমন লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো তাদের দিকে। টুকটুকের দুটো বোনকে ওরা জবাই করে খেয়ে ফেলেছে। ভাবলে গা শিরশির করে টুকটুকের। কুলসুমের কারণেই আজ বেঁচে আছে টুকটুক। কুলসুম ওকে বড্ড ভালোবাসে। টুকটুক জানে ও যদি বেশি বেশি ডিম না পাড়তো তাহলে এতোদিনে হয়তো তার অবস্থা অন্যন্যো ভাই-বোনের মতোই হতো। কুলসুমের ভালোবাসাও ওকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতো না। এমনই স্বার্থপর মানুষগুলো। শুধু লাভ ছাড়া আর কিছুই বুঝে না। বাকি বোনগুলো কোথায় আছে ও জানে না।
ওর নাম টুকটুক। নামটা কুলসুমই দিয়েছে। বছর দুয়েক আগের কথা। একদিন তার ছানাগুলোকে খাবার খাওয়াচ্ছিলো টুকটুক। খাবার খেতে খেতে তার ছানাগুলো একটু এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়ে। ছানাগুলোকে এক করতে টক টক শব্দ করতে হয়। যেহেতু এখনো নিজের আত্মরক্ষার ব্যপারটি শিখতে পারেনি ছানারা তাই টুকটুককেই ছানার খবর রাখতে হয়। সেদিন ছানাগুলোকে এক করতে টক টক শব্দ করেছিলো। হঠাৎ কোথেকে ভোঁতা একটা শব্দ ভেসে এলো। “ঠক ঠক।” চারদিক তাকিয়ে অন্যকোনো মুরগী দেখতে পেলো না টুকটুক। তবে একটা মানুষ দেখতে পেলো। অবাক করা বিষয় এই মানুষগুলো যে কী! এতো বড় শরীর হয় কেন? ভেবে পায় না টুকটুক। মানুষটা এখন তাদের ঘরের দড়জার সামনে বসে আছে। এমন সময় আবার শুনতে পেলো সেই ভোঁতা শব্দ। “ঠক ঠক।” অবাক হয়ে দেখলো টুকটুক, শব্দটা মানুষই করছে। খুব বিরক্ত লাগলো, এ কী রে বাবা। তা, সুর যখন নকল করেছিস তো ভালোভাবেই কর। কী বনমোরগের মতো “ঠক ঠক!” বিরক্ত হয়ে আবার ছানাগুলোর খাবার যোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো টুকটুক। ও জানে সময় নষ্ট করে লাভ নাই। মানুষটার কাজ নাই তাই হয়তো বসে বসে সময় নষ্ট করছে। এমন সময় আবার একটা শব্দ হলো, টুক টুক । টুকটুক দেখলো, মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে টুক টুক শব্দ করছে। এবার আর শব্দটা বিরক্তকর মনে হলো না। কেমন ভালো ভালো লাগলো। বাহ! মানুষরাতো অনেকরকম শব্দ করতে পারে। কেউ তো তার সামনে এমন টুক টুক শব্দ করে না। সেও একটা টক টক শব্দ করলো। মেয়েটাও আবার টুক টুক করে শব্দ করলো। টুকটুক বুঝতে পারলো মেয়েটা ওকে খুব পছন্দ করে, তাই হয়তো তার সাথে কথা বলতে চায়। বাচ্চগুলো আবার ছড়িয়ে পড়েছে তাই তখন আবারো টক টক শব্দ করে তার ছানাগুলোকে ডাকতে লাগলো। সে শুনতে পেলো মেয়েটাও তার সাথে টুক টুক করছে। বাহ! মেয়েটা দেখছি দিব্বি আমার সুর নকল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু হচ্ছে না। টুক টুক শব্দ করলে তো ছানারা এক হবে না। করতে হবে টক টক। যাই হোক এরপর থেকে প্রতিদিন কুলসুম ওকে দেখলেই টুকটুক করে শব্দ করে। প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও টুকটুক এখন বুঝে আসলে ওর নাম দিয়েছে টুকটুক। ওর সুর নকল করে ওর ছানাগুলোকে ডাকা উদ্দেশ্য নয়। টুকটুক নামটা তার পছন্দ হয়ে যায়। মেয়েটা খুব ভালো। টুকটুক শব্দ করলে ও যখন ছানা নিয়ে কাছে যায় তখন ওকে কিছু না কিছু খেতে দেয়।
প্রতিদিনের মতো আজও কুলসুম ওদের খোঁয়াড় খুলে দেয়। তারপর খাবার দেয় টুকটুক ও তার ছানাগুলোকে। ছানাগুলো একটু আধটু খায়। টুকটুকই খায় বেশি। এরকম শক্ত বড় চাল ছানাগুলো খেতে শিখেনি। একটু বড় হলেই পারবে। আজও কুলসুম বসে বসে মুরগীগুলোর কান্ড দেখছে। কীভাবে মা মুরগীটা ছানাগুলোকে খাবার জোগাড় করে দেয়। এসব দেখতে ভালোই লাগে কুলসুমের। বসে বসে স্বপ্ন দেখে কুলসুম। একদিন বড় হলে ও অনেকগুলো মুরগী পুষবে। মুরগীর ছানা খুব ভালো লাগে ওর। কি সুন্দর তুলতুলে গা। দেখলেই কেমন আদর করতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে ছানাগুলো তার হাতের উপর উঠে বসে থাক। তখন মাথায় একটু একটু করে আঙুল বুলিয়ে আদর করবে। টুকটুকও মনে হয় বুঝতে পারে কুলসুমের ইচ্ছার কথা। তাই তার আশেপাশে ছানাগুলো নিয়ে ঘুরঘুর করতে থাকে। এমন সময় হাত বাড়িয়ে দেয় কুলসুম। প্রথমে ভয়ে একটু পিছিয়ে যায় তার ছানাগুলো। কিন্তু একটু পরই কুলসুমের হাতে উঠে বসে কয়েকটি ছানা। মনে মনে হাসে টুকটুক। ছানাগুলো কী নির্ভয়ে হাতের উপর উঠে বসে আছে। এই মেয়েটা থাকলে একটু নিশ্চিন্তে থাকা যায়। হিংস্র কোনো প্রানী কাছে আসে না। মেয়েটাকে ভয় পায় হিংস্র প্রানীগুলো কিন্তু ছানাগুলো মোটেও ভয় পায় না। ইস... সব মানুষগুলো যদি এমন হতো। একটু বড় হলে তার ছানাগুলোও দেখতে পারবে না। মানুষগুলো এমন হিংস্র হয় কেন? খালি খেয়ে খেয়ে শেষ করে ফেলে। পাশের বাড়ির লাল গরুটার কথা এখনো মনে পড়ে। এত্তবড় একটা প্রানী, মানুষ থেকেও বড়। সেটাকে জবাই করে খেয়ে ফেলেছে। কি ভয়ানক! এই মানুষগুলোর মাঝেই আবার মায়া-মহব্বত আছে। সেটা বিশ্বাস করতে পারতো না টুকটুক। কুলসুমকে দেখে তার ধারনা পাল্টেছে।
চৈত্র মাস। প্রচন্ড তাপ সূর্যের। বাতাসে সূর্যের তাপ মিশে বাতাসও কেমন গরম হয়ে যায় । সেই বাতাস গায়ে লাগলে জ্বালা করে। একেই বুঝি বলে লু হাওয়া। খোলা জায়গার বাতাস গায়ে জ্বালা ধরালেও গাছের ছায়ায় সেটা বেশ ঠান্ডা মনে হয়। তাই কৃষক গাছের ছায়ায় বসে ক্লান্তি দূর করে। মাস দুয়েক পরের কথা। মিষ্টিআলুর ঝোপে বসে আছে টুকটুক। ছানাগুলো মোটামুটি বড় হয়েছে। এরই মাঝে টুকটুকের ছানাগুলো নিজের খাবার খুঁজতে শিখে গেছে। আত্মরক্ষার কৌশলও শিখে নিয়েছে। তাই নিশ্চিন্তে ঝোপে বা গাছের আড়ালে বসে বাচ্চাদের পাহাড়া দিয়েই সময় কাটে টুকটুকের। টুকটুকের ছানাগুলো মধ্যে এখন বেঁচে রয়েছে ছয়টি। দুটি ছানা হিংস্র পাখি বা প্রানীর কবলে পড়েছে। তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। দুদিন আগে জরিমন বিবি তার একটা ধরে নিয়ে যায় সকাল সকাল। পরে ওই ছানাটার কী হয়েছে জানে না টুকটুক। ছানার কথা ভাবলে কষ্ট লাগে। বুক ফেটে কান্না আসে। তবে সে কাঁদতে পারে না। তার আগের ছানাগুলোর কথা মনে পড়ে। এতোগুলো ছানা ছিলো তার একটাও নেই আজ। এ ছানাগুলোও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। এটাই যে নিয়তি। ছানাটা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর অন্য ছানাগুলোও আতঙ্কে থাকে। কখন কাকে ধরে নিয়ে যায়। ছানাগুলো মার পাশে বসে থাকে। সবারই মন খারাপ। ছোট ছানা বলে, মা বড় ভাইয়াটা কই?
টুকটুকও জানে না কোথায়। তাই চুপ করে থাকে। তৃত্বীয় ছানাটা বলে, মা, ওই মেয়েটা কই? যে মেয়েটা আমাদের অনেক আদর করতো। এবারো কিছুই বলে না টুকটুক। ও জানে না মেয়েটা কোথায়। বেশ কদিন হলো মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে না। দ্বিতীয় ছানাটা বলে, কোথাও কি বেড়াতে গেছে?
জানে না টুকটুক। মুখ খুলে এবার, হয়তো বেড়াতে গেছে। পঞ্চম ছানাটা বলে, মেয়েটা থাকলে ভাইয়াকে হারাতে হতো না। তাই না মা? মাথা দোলায় টুকটুক। হয়তো বা। ছোট ছানাটা বলে, মা চলো আমরা পালিয়ে যাই। হেসে ফেলে টুকটুক। এ হাসি আনন্দের না, কষ্টের । বলে, দেখো মা, এটাই আমাদের নিয়তি। এভাবেই থাকতে হবে আমাদের। আমরা হয়তো পালাতে পারবো। কিন্তু পালিয়ে যাবো কই? হয়তোবা অন্য জায়গা আরো বেশি খারাপ। অন্য জায়গার মানুষগুলো আমাদের ধরতে পারলেই খেয়ে ফেলবে। তাছাড়া এ বাড়িতে হিংস্র প্রানীর উৎপাত কম। আমাদের ভাগ্যে যা রয়েছে তা মেনে নিতে হবে। মা’র কথায় ছানাগুলোর মুখে থেকে কোনো কথা বের হয় না। চুপচাপ বসে থাকে। কেমন একটা আতঙ্ক সবার মাঝে। দেখতে দেখতে সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ে। ধীরে ধীরে অন্ধকার হয় চারদিক। অন্ধকারের সাথে সাথে তাদের ভয়টা আরো বাড়ে। ছোট ছানাটা মার ডানার নিচে আশ্রয় নিতে চেষ্টা করে। কেমন একট শূন্যতা আর অসম্ভব নীরবতা। কেবল দূরে, অনেক দূরে... বনে, গাছের ডালে পাখির কিচিরমিচির অস্পষ্ট শব্দ। আজ ওদের আর খোঁয়াড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না।

01-02-2016

Comments

Popular posts from this blog

ভালোবাসি

নদী

স্বাধীনতা