স্বাধীনতা

© তারিক ওয়ালি 

ছেলেটাকে মারতে মারতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলো লোকটা। ছেলেটার হাতের বস্তা পড়ে গেলো রাস্তায়। হতবাক হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। মার খেতে খেতে ঘটনা বুঝার চেষ্টা করলো। কি অপরাধে তাকে মারা হচ্ছে? না, কিছ্ইু বুঝতে পারলো না। কিছুক্ষণ পর মার খেয়ে চিৎকার করতে লাগলো অসহায় ছেলেটা। দু মিনিটেই আশেপাশে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেলো।  দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো তামাশা। যেনো এরচে বড় তামাশার বস্তু পৃথিবীতে নাই। কেউ এগিয়ে এলো না ছেলেটাকে মারের হাত থেকে রক্ষা করতে। হয়তো ৯০ শতাংশ লোকই জানে না কেনো মার খাচ্ছে ছেলেটা। কী অপরাধ তার! তামাশা দেখা বাঙালিদের চিরায়ত বৈশিষ্ট্য। শত ব্যস্ততার মাঝেও বিনোদন খুঁজে পায় তারা। হোক সেটা কাউকে মারার দৃশ্য কিংবা হকারের গালভর্তি চাপাবাজি। ছেলেটার কতদিন গোসল হয়নি কে জানে! হাতে-পায়ে ময়লার পুরো আস্তরণ। মাথার চুল লালচে-বাদামী রং ধারণ করেছে। হাফপ্যান্ট পরা কাগজকুড়ানি ছেলেটার জন্য বুকটা কেমন  মোচড় দিয়ে উঠলো রশিদের। পুরো ব্যাপারটা দেখলো রশিদ। মন খারাপ হলো প্রচন্ড, কিন্তু কিছুই করতে পারলো না। ইচ্ছা করলেই পারে এগিয়ে গিয়ে ছেলেটাকে মারের হাত থেকে রক্ষা করতে কিংবা বাঁধা দিতে। কিন্তু কেনো যেনো তার এগুলো থেকে দূরে থাকতে ইচ্ছা করে। কেউ মার খাক এটা চায় না কিন্তু কারো সাহায্যে এগিয়ে যায় না ও। ঠিক কি কারণে, সেটা নিজেও খুঁজে পায়না। যেখানে বড় বড় চোরেরা শাস্তি পায় না  সেখানে, ছিটকে চোর মার খাবে এটাই নিয়ম। কখনো কখনো অস্বাভাবিক ব্যাপারগুলোই খুব স্বাভাবিক হয়ে যায়।

প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে বাসায় ফিরলো রশিদ। আজকাল তার এমন সমস্যা হচ্ছে খুব  বেশি। নিতান্তই সাধারণ একটা ব্যাপার নিয়ে এতটাই মন খারাপ হয় যে, ঠিক কি কারণে মন খারাপ হয়েছে সেটাই ভুলে যায়। মন খারাপ হলে যত আজে-বাজে চিন্তা মাথায় এসে ভীড় করে। ওইদিন হঠাৎ করে খুব মন খারাপ হলো রশিদের। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো যেনো। মনে হচ্ছিলো, এই বুঝি পরপাড়ে চলে যাবে। অথচ খুবই ক্ষুদ্র একটা ব্যাপারে মন খারাপ হয়েছিলো তার। মাঝে-মাঝে মনে হয়, হয়তো সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। কিংবা তার বড় ধরনের কোনো সাইকো প্রবলেম আছে। এই নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্লানও করেছে সে। কিন্তু কেনো যেনো আর যাওয়া হয়নি। কোনোকিছুই তার করি করি করেও করা হয় না। সবকিছুতেই প্রচন্ড উদাসীন সে।

রশিদ ভাবে, আচ্ছা, হাসিখুশি মানুষগুলো কী খুব গোপণে মনের গহীণে লুকিয়ে রাখে পাহাড়সম দু:খ-কষ্ট? যাদের মন খুব খারাপ থাকে বা মনে খুব কষ্ট থাকে তারা কি রশিদের মতোই পাগলামো করে? মানসিক চাপ আর কষ্টগুলোকে ভুলে থাকতেই কী হাসিখুশি ভাব নিয়ে বসে থাকে। হয়তো বা, নিজেই উত্তর দেয় ও। যদি হাসিখুশি না থাকা যায়, তাহলে সেই মানসিক চাপ প্রভাব ফেলবে শরীরে। তখন অবস্থা আরো খারাপ হবে। রশিদ একবার একজনকে দেখেছিলো, তার সাথে পরিচয় ছিলো বেশ কয়েক মাস। মানুষটা সবার সামনে খুব দুষ্টামি করতো। কিন্তু একাকী হলেই চোঁখের জলে বালিশ ভিজতো তার। বাথরুমে কাঁদতো মন হালকা হওয়ার জন্য। শাওয়ারের পানিতে ধুয়ে যেতো নোনাজল। নিজেকে চোখের জল থেকে আড়াল করার কী অদ্ভুত বুদ্ধি! অথচ  দেখে বুঝার উপায় নাই সেই মানুষটাই এমন অভিজ্ঞতা লালন করছে নিজের ঝুলিতে। তার সাথে যোগাযোগ নাই আজকাল। ইচ্ছা করেই নিজেকে আড়াল করেছে রশিদ। আজ কেনো যেনো খুব ইচ্ছা করছে সেই মানুষটার সাথে কথা বলতে। সে তুলনায় নিজের কষ্টগুলো ভাবলে নিজেকে গাধা মনে হয়। কেনো যে নিজেকে এতো অসহায় ভাবে রশিদ। নিজেও খুঁজে পায় না যুঁতসই কোনো কারণ।
বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে হয়ে কম্পিউটারে বসলো রশিদ। ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশ করলো ও। একটা সময় ছিলো, যখন নিয়মিত ডাইরি লিখতো রশিদ। এখন ফেসবুকই তার ডাইরি। ফেসবুকে সবকিছুই লিখে ও। জিবনের অভিজ্ঞতা সহ যা ইচ্ছা তাই। ডাইরি আর ফেসবুক যদিও এক না তারপরও কেনো যেনো, ফেসবুককেই আজকাল বেশি সময় দেয়। কয়েকদিন আগে যখন তার মন খারাপ ছিলো, তখন একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলো,
“নাই কিরে সুখ, নাই কিরে সুখ
এ ধরা কি শুধু বিষাদময়?
যাতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে
কেবলি কি নর জনম লয়?
বলো ছিন্ন বীণে, বলো উচ্চৈ:স্বরে
না না না... মানবের তরে।
(সংক্ষেপিত)
 কামীনি রায়ের এই কবিতাটা কয়েকদিন যাবত আওরাচ্ছি। অর্থের দিকে লক্ষ্য করলে খুব ভালো লাগে। আসলে মানুষকে উপকার করতে পারার মাঝেই প্রকৃত আনন্দ রয়েছে। আপনি যতই কষ্টে থাকুন, মানুষের দিকে তাকান যে আপনার চেয়েও কষ্টে আছে। বিশ্বাস করেন, একটু হলেও শান্তি পাবেন। তাছাড়া উপরওয়ালা একজনতো আছেন, যিনি মানুষকে হতাশ করেন না। মানুষ মানুষকে কষ্ট দেয়, প্রতারণা করে মানুষ। উপরওয়ালা তো মানুষকে ঠকান না। তাহলে উনার কাছে চাইতে সমস্যা কি?”
এমনি আরো অনেক স্ট্যাটাস বা মনের অবস্থা শেয়ার করে বন্ধুদের সাথে। নীতিকথা ও খুব বলে। কারণ মানুষকে বললে, নিজের মানতে সহজ হয়। আজকাল নিজেকে আনন্দে রাখার জন্য সবার সাথে মজা করে ও। চাই ক্লাশমেট কিংবা ফেসবুক ফ্রেন্ড। কয়েকদিন হলো, মজা করে অনেক পাগলামি করছে ও। কেউ তার পাগলামিতে মজা পায়, কেউ বা আবার চরম বিরক্তিবোধ করে। কোনো কিছুইতে রশিদ সিরিয়াস হতে পারে না। অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলোতে ও খুব সিরিয়াস। নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগে। আর্শ্চয! আমি এমন কেন? বিড় বিড় করে নিজেই। সবকিছুতেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে ও। খুঁজে পায় না কূল-কিনারা।  কিন্তু আজ থেকে সে প্রতিজ্ঞা করেছে কখনো ভালো ব্যাপার বাদে অন্য কোনো ব্যাপারে সিরিয়াস হবে না। আর ভালো ব্যাপারগুলোতে  যেভাবেই হোক সিরিয়াস হতে হবে। প্রতিজ্ঞা করে, পরক্ষণেই নিজে নিজে একচোট হাসে ও। কতদিন যে এমন হয়েছে তার কোনো ইয়াত্বা নেই। আসলে, মানুষ প্রতিজ্ঞা করে প্রতিজ্ঞা ভাঙার জন্য।

 সেই যে বিকেলে কাগজকুড়ানি ছেলেটাকে দেখে মন খারাপ হয়েছিলো, এখনো মন ভালো হয়নি রশিদের। এখন বাজে রাত ১০ টা। ও ভেবে পায় না। আসলে কি সবারই ওর মত অবস্থা হয়? নাকি... আর ভাবতে চায় না ও। মাঝে মাঝে ভাবে, আশেপাশের প্রতিটি মানুষকে ও ঠকাচ্ছে। কীভাবে ঠকাচ্ছে সেটা নিজেও বলতে পারবে না। তবে নিজেকে যে ঠকাচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নাই ওর। যদিও ওর মনে হঠাৎ করেই তখন একটা কবিতার লাইন বারবার মনে পড়ছিলো, ‘আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে।’।
 ছোটবেলায় রশিদ অনেক স্বপ্ন দেখতো। দুটি শখ ছিলো তার। একটি হলো সুন্দর দেখে অ্যারাবিয়ান ঘোড়া কিনবে ও। তারপর টগবগ করে ঘুরে-বেড়াবে সেই ঘোড়ায়। আরেকটি শখ হলো, অসহায় শিশুদের জন্য কিছু একটা করবে। কিন্তু কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সে। অসহায়দের জন্য কিছু করতে পারলে তার ভালো লাগতো। যদি কিছু করতে পারতো তবে আজ কাগজকুড়ানি ছেলেটা নিশ্চিত মার খেতো না। আজকাল সে দুটি শখও মরে যেতে বসেছে। কোনোকিছুই তার ভালো লাগে না। নিজেকে ব্যস্ত রাখে, ভালো রাখার চেষ্টা করে। আচ্ছা, সময়ের পরিবর্তনে কি মানুষের ইচ্ছাগুলোও বদলে যায়?

ক্লাশে স্যার বলেছিলো, বাঙালিদের ধৈর্য্য খুব কম। আর তারা অল্পতেই হতাশ হয়। যারা হতাশ হয় না, তারা সফলতা অর্জন করে। চেষ্টা করতেই হবে। চেষ্টার কোনো বিকল্প নাই। তাই, রশিদ খুব চেষ্টা করলো, সব হতাশা ভুলে যেতে। হতাশা মানুষকে কিছুই দেয় না। হতাশা মানুষকে পঙ্গু করে তোলে।
শীতের রাতগুলো খুব নিরব হয়। দূর থেকে ভেসে আসা ভাটিয়ালি গান কিংবা কোনো উদাসি বাঁশির সুরও পষ্ট শোনা যায়। তখন বুকটা কেমন হু হু করে ওঠে। ভয় ভয় লাগে। শীতের রাতে ফিলামেন্টের হলুদ আলো কিংবা এনার্জি বাল্বের সাদা আলোগুলোও কেমন ফ্যাকাশে দেখায়, যেনো সাদা আলখেল্লা পরিহিত কোনো অতিপ্রাকৃতিক বস্তু ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরময়।
রাত ২ টা। রশিদ এই শীতের রাতেও চেয়ার পেতে বসলো বেলকুনিতে। কাগজ কলম নিয়ে বসলো সে। হতাশা, ভয় আর যতরকম নেগেটিভ চিন্তা রয়েছে সবগুলোর কবর রচনা করবে আজ। জীবন তো একটাই। তাকে হতাশ হলে চলবে না। সে যদি হতাশ হয় তাহলে কে স্বপ্ন দেখাবে কাগড়কুড়ানির মতো ছেলেদেরকে? কে দেখাবে গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের হওয়ার স্বপ্ন? বাসের ছোট ছোট হেলপারদেরকে কে বলবে পড়ালেখার কথা? শিখাবে স্বাধীনতার কথা। শিখাবে স্বাধীনতা মানে মৌলিক অধিকার। স্বাধীনতা মানে দুর্নীতি নয়। স্বাধীনতা মানে মিথ্যাচার নয়। স্বাধীনতা মানে অন্যের হক নষ্ট করা নয়। স্বাধীনতা হলো দেশের কল্যান, দেশের উন্নতি। স্বাধীনতা একটি স্বপ্ন। স্বাধীনতা মানে এক টুকরো  স্বর্গ। ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যায় রশিদ। ভাবতে ভাবতে চোখদুটি তার কেমন ভিজে যায়। আচ্ছা, এটা কি আবেগ নাকি স্বপ্নের নোনাজল?
 আজ সে প্রতিজ্ঞা করে, সে ভুলে যাবে না কিছুই । তাকে মনোযোগী হতে হবে। তাকে আখিরাতের সাথে সাথে দুনিয়ায়ও ভালো কিছু করতে হবে। মানুষকে জানাতে হবে দুনিয়া ও আখেরাতের কথা।  আজ হতাশা ঝেড়ে ফেলার রাত। ১২ই ডিসেম্বর। রাত ১২ থেকে শুরু হয়েছে তার জীবনের নতুন আরেকটি বছর। আরেকটি অধ্যায়। অতীত নিয়ে ভেবে লাভ নাই। আজ থেকে সে অন্য এক রশিদ । কোথায় যেনো সে শুনেছিল, ইচ্ছা আর মনের জোর থাকলে সবই সম্ভব। আজ থেকে সে সময়মত নামাজ পড়বে। অস্থিরতা কাটানোর জন্য এরচে ভালো উপায় সে খুঁজে পেলো না। নিয়মিত কোরআন তেলওয়াত করবে ও। রুটিনমতো সবকিছু করার চেষ্টা করবে। রুটিন মেনে চলা কখনোই হয়ে ওঠেনি ওর। তারপরও ওকে মানতে হবে। প্রতিজ্ঞায় শক্ত হয়ে ওঠে হাতের মুষ্টি। দূরের কোনো ফিলামেন্ট বাল্বের হলুদ আলো তার চশমাকে ভেদ করে পড়তে পারে চকচকে চোখের ভাষা। আজ তাকে প্রতিজ্ঞা ভাঙলে চলবে না। তাকে মানতে হবে। মানতে তাকে হবেই।

Comments

Popular posts from this blog

ভালোবাসি

নদী