অনুগল্প : খরগোশ

© তারিক ওয়ালি
মানুষ খারাপ হতে পারে কিন্তু প্রাণী তো কখনো খারাপ হতে পারে না।
ছাদে মোটামুটি বড় সাইজের 5 তলা বিশিষ্ট একটা খাঁচা রয়েছে। একসময় আমরা 25 জোড়া কোয়েল পালতাম ওটায়। এখন আর কোয়েল নেই। শূন্য খাঁচা শূন্য পড়ে ছিলো দীর্ঘদিন।
বছর খানেক আগে একটা খরগোশের আমদানী হয়। খরগোশের আবাস এখন ওই খাঁচা। খরগোশটা কীভাবে এলো, তার একটা মোটামুটি ইতিহাস রয়েছে। এটাকে কেনা হয়নি। উইল করে যায়নি মালকিন। একপ্রকার দান করে গেছে বলা চলে। চরম ঘৃণিত সেই দান। তার ইতিহাস খুব একটা সু্ন্দর না। এর পিছনে রয়েছে একটা জীবনের গল্প। ব্যর্থতার গল্প। ঝং ধরা জীর্ণ-শীর্ণ খাঁচার মতই করুণ খরগোশের জীবনকাহীনি।

একসময় যে খরগোশটা ছিলো রাজার হালতে, সে এখন পথের ভিখিরি। সারাদিন অপেক্ষা করে খাওয়ার জন্য। হয়তো পায় দু-একটা গাছের পাতা, গাজর আর শশা। কোনোদিন না খেয়ে থাকে। বিশ্বাস করেন, কাছে গেলেই খাবার পাবার আশায় অস্থির হয়ে উঠে ওটা। হাত চাটতে হাতে। তখন মন খারাপ হয় প্রচন্ড। কি দোষ এই অবলা প্রাণীর? মানুষ মানুষের সাথে প্রতারণা করে। তার ফল কেন ভোগ করবে এই নীরিহ একটা খরগোশ? তার উত্তর আমার জানা নাই। আচ্ছা? খরগোশের কি ভাগ্য থাকে? তার ভাগ্যই কি এমন ছিলো? থাকে হয়তো। হয়তো থাকে না। আমি জানি না।
র্দীঘ পাঁচ বছরের সংসার ত্যাগ করে সুন্দরী মেয়েটা যখন অবলীলায় অন্যের হাত ধরে চলে যায় তখন মানবতা সত্যিই প্রশ্নের সমুখ্খীন হয়। ধর্মের কথা বাদই দিলাম। ধর্মীয় অনুশাসনে বড়ো হলে মেয়ে কখনোই এ কাজ করতে পারতো না। মেয়ের এমন নির্লজ্জ উদাহরণে অবাক হয় সবাই। স্বামী আর খরগোশের মাঝে তখন খুব একটা ফারাক করা যায় না। এ ঘটনা ভুলে যায় সবাই। কিন্তু ছেলেটা কখনো ভুলে না; খরগোশও। ভুক্তভোগী দুটি প্রাণীই।
প্রায় বছরখানেক আগে খুবই স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভাবিক কোনো কারণে চলে যায় সুন্দরী মেয়েটা। বাড়িওয়ালার ড্রাইভারের কাছে রেখে যায় খরগোশটা। স্বামী বেচারা জানে না ঠিক কি কারণে চলে গেছে তার বউ। অথচ এই মেয়েটার সাথেই ছিলো প্রেম। তারপর হয় বিয়ে। কত আবেগ আর ভালোবাসা ছিলো। ছিলো কতো খুঁণসুটি আর ঝগড়া। যাই হোক, সেই ভালোবাসা আর প্রেমের কবর রচিত হয়েছে, যার নীরব সাক্ষী খরগোশ। হয়তো কিছুই বলতে পারে না। মানুষও জানতে পারবে না কার অপরাধে ভেঙেছে 5 বছরের সংসার। কিন্তু খরগোশ ঠিকিই জানে। এক সময় যে তাকে পরম মমতায় শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাতো সেই মানুষটাই এতটা নির্দয়? তার কি খরগোশটার কথা মনে পড়ে?
অবলা প্রাণীটা কথা বলতে পারে না। তাই হয়তো সংসার টিকিয়ে রাখার মত সদউপদেশ দিতে পারেনি কাউকে। তীক্ষ্ণ মেধা আর ব্যারিস্টারি সার্টিফিকেটও তখন কোনো কাজে লাগে না ছেলেটার। নিজ যোগ্যতায় এতো উপরে উঠা ছেলেটা কিছুই করতে পারেনি। ছেলেটার তো কোনো কিছুরই অভাব ছিলো না। তারপরও এমন হয়েছে। সেই ছেলেটা ভাঙা হৃদয় নিয়ে চলে গেছে দূরে কোথাও। তাদের পরিবর্তে সেই ফ্লাটে ওঠেছে নতুন দম্পতি।
ভাগ্যের নির্মম আর করুণ অবস্থা বরণ করে আজো বেঁচে আছে খরগোশটি। আমি মাঝে মাঝে ছাদে যাই। ব্যস্ততার কারণে আগের মতো যাওয়া হয় না। আগের মতো আর আড্ডা দেওয়া হয় না। সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, রাত গড়িয়ে আবার সকাল। এভাবেই ঘুরতে থাকে দিন, মাস, বছর। গরম, রোদ-বৃষ্টি আর শীতের মাঝেও বেঁচে আছে খরগোশটি। আজো শুধু সাক্ষী হয়ে আছে, লোহার শিকে আবদ্ধ সেই খরগোশ। খরগোশটাকে দেখলে আজো আমার মনে পরে একজোড়া উচ্ছ্বল তরুণ-তরুণীর কথা। হৃদয় ভাঙার গল্প আর খরগোশের অতীত ইতিহাস। তার সুখের দিনগুলো।

Comments

  1. তারিক ভাই, লিখে যান। দুই হাজার ষোল হোক আপনার জন্য অন্যতম একটি সাল। লেখায় লেখায় ভরে উঠুক আপনার ব্লগ।

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ ভাই।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ভালোবাসি

নদী

স্বাধীনতা