যন্ত্রণা (ছোটগল্প)
© তারকি ওয়ালি (ফজুদা)
গতরাত থেকে মাথা ব্যাথা করছে মুরাদের। ক্রমেই বাড়ছে। মাথা ব্যাথা কোনো রোগ না। একটু ভালো ঘুম কিংবা বিশ্রামে থাকলেই সেরে যাওয়ার কথা কিন্তু সারছে না। সকাল থেকে হঠাৎ করেই কেমন হাঁটু আর পায়ের গোড়ালিতে ব্যাথা করছে। ব্যাথাটা কেমন অবশ অবশ ভাব এনে দেয়। জ্বর আসবে নাকি? মুরাদের একটু ভয় ভয় করছে। যদি জ্বর আসে তাহলে এন্টিবায়োটিক ছাড়া কখনোই জ্বর ছেড়ে যায় না। বিছনায় শুলেই হুট করে জ্বর চলে আসতে পারে। অতীতেও এমন হয়ছে অনেক। এ কারণেই বাসায় ফিরছে না মুরাদ। বাসায় ফিরলে যদি আলসেমি লাগে। তারচে বরং এখানে বসে থাকাটাই ভালো। অনেকেই হয়তো তাকে পাগল বা ভবঘুরে ভাবছে। ভাবুক। তাতে কী? আসলে এই ভর সন্ধায় কেউ যাত্রিছাউনীতে বসে থাকে না।
পুরো ছাউনিজুড়ে বেসরকারি একটা মোবাইল কোম্পানির বিজ্ঞাপণ। বিজ্ঞাপনের মডেল; একটা মেয়ে ও একটা ছেলে। তাদের হাসিমাখা চেহারা দেখে মুরাদের মনে হলো, অযথাই হাসি দিয়ে দাঁত বের করে আছে মডেলদুটো। হাসিটা তার কাছে ভয়ানকই মনে হলো। যদি মানুষের বত্রিশটা দাঁতের বদলে ৬৪ টা দাঁত থাকতো তাহলে মনে হয় মডেলদুটো ৬৪ টা দাঁতই বের করে অতিকায় হাসি হাসতো। ভয়ানকের মাত্রাটাও বাড়তো তখন। মোবাইল কম্পানির বিজ্ঞাপণ না হয়ে টুথব্রাশ কিংবা টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন হলে বেশ হতো। মুরাদ অবাক হয়, যার টাকা আছে অযথাই টাকা খরচ করে। এ যাত্রীছাউনিটা এখানে না দিলেও হত। দেশের মোবাইল কোম্পানিগুলো দেদারছে টাকা কামাচ্ছে, সুতরাং এমন দু-একটা যাত্রীছাউনি তৈরি করলেই বা কী? ফাঁকতালে ওদের বিজ্ঞাপনটা দেওয়া হলো। গুলশানের মতো এলাকায় ছোটখাটো একটা বিলবোর্ডের জন্যও বেশ টাকা গুনতে হয়।
শহরের ব্যস্ত মানুষগুলো অফিস বা কাজ সেরে বাড়ি ফিরছে। হাঁটতে হাঁটতে একপলক তাকে দেখছে। এমনভাবে তাকাচ্ছে যেনো ওর চেয়ে অসহায় কোনো মানুষ পৃথিবীতে নাই। ব্যপারটা বেশ মজার। বিশেষ করে যখন কেউ তার দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকায় তখন খুব আনন্দ লাগে মুরাদের। মানুষ জানেই না যে সে, অসহায় না। অসহায় না হয়েও অসহায় সেজে বসে থাকার মধ্যে আলাদা আনন্দ রয়েছে।
কিছুক্ষণ আগে একটা সুন্দর মেয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। রিশকাওয়ালা থেকে শুরু করে সবধরনের মানুষই হাঁ করে তাকিয়ে ছিলো মেয়েটার দিকে। কেউ কেউ মেয়েটার পা থেকে মাথাঅবধি অন্তত দশবার পরখ করেছে এই অল্পসময়টাতেই। কেউ দু-এক নজর দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কেউবা আবার এই ভীড়ে যতটুকু সম্ভব মেয়ের দিকে শুরু থেকে শেষ পযর্ন্ত ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে ছিলো। সুন্দর মেয়ে দেখলে সবসময়ই আশেপাশে তাকায় মুরাদ। মেয়ে দেখার চেয়ে আশেপাশের মানুষগুলোর অবস্থা দেখতেই বেশি মজার। ফিক করে হেসে ফেললো মুরাদ। মানুষের মতো অদ্ভূত প্রানী আর কোথাও মনে হয় নাই।
লেকের পানি কয়েকদিন হলো বেশ বেড়েছে। এখন ভাদ্র মাস। পানি বাড়ার কথা না। অন্যান্য বছর এসময় পানি কমে যায়। দূর থেকে গাড়ির হেডলাইটের আলো কিংবা বড় বড় দালানের বাতির আলোতে পানি জ্বলজ্বল করছে। যেনো হাজারো তারা নেমে এসেছে পানিতে। দেখতে বেশ লাগছে মুরাদের। ‘ইস... কি টলটলে পানি।’ মনে মনে বলে মুরাদ। এরকম টলটলে পানি দেখলে পানিতে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করে। বিশেষ করে যখন প্রচন্ড গরম থাকে, গরমে হাঁশফাশ করে সবাই। অবশ্য তখন পানি এতো টলটলে আর স্বচ্ছ থাকে না। গ্রীষ্মে পানি শুকিয়ে যায় অনেক। তখন পচাঁ গন্ধ বেরোয়।
আটটা বেজে গেলো দেখতে দেখতে। বাসায় যাওয়ার গলির মাথায় মসজিদ রয়েছে। নামাজ সেরে বড় রেঁস্তোরায় ঢুকলো মুরাদ। ম্যানেজার লোকটাকে ভালো লাগে মুরাদের। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে লোকটা। কখনো কর্মচারীদের গালি দিতে শুনেনি। তাছাড়া রেঁস্তোরার খাবারের মান আর আট-দশটা রেঁস্তোরা থেকে ভালো। মুরাদের পছন্দের খাবার গ্রিল আর নান। মাসে অন্তত চার-পাঁচবার গ্রিল আর নান খায় রাতে। অনেক সময় ভালো খাওয়া-দাওয়া হলে হালকা-পাতলা রোগ সেরে যায়। আজ অসুস্থ শরির নিয়ে ভরপেট খেলো মুরাদ। ঠিক সাড়ে আটটায় বের হলো রেঁস্তোরা থেকে।
রেঁস্তোরা থেকে বের হওয়ার পর অযথাই মন খারাপ হয়ে গেলো। এবং সেটা পাঁচ মিনিটের মাথায় এতটাই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করলো যেনো, দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই সমস্যাটা আজকাল খুব বেশি হচ্ছে। মন খারাপ হলে কারো মাথা ঘুরায় কিনা মুরাদ জানে না। কিন্তু তার প্রচন্ড মাথা ঘুরায়। দম বন্ধ হয়ে আসে। বনবন করে ঘুরে পুরো পৃথিবী। মরে যেতে ইচছা করে। দুনিয়ার কিছুই তখন ভালো লাগে না। সব কেমন অন্ধকার লাগে। হাত-পা কাঁপে। ধরফর করে বুক।
অনেক আগে মুক্তার প্রেমে পড়েছিলো মুরাদ। মুক্তাকে না পাওয়ার সম্ভবনাই বেশি ছিলো কিন্তু তারপরও প্রেমে পড়েছিলো। মুক্তাকে পায়নি সে। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। মুক্তার বিয়ে হয়েছে এই খবর জানার পর কেমন দম বন্ধ হয়ে এসেছিলো মুরাদের। খুব খারাপ লেগেছিলো। মাসখানের পর আর তেমন কিছুই মনে হয়নি। আজকাল খারাপ লাগার মাত্রাটা অনেক অনেক গুণ বেশি। তখনও তো এতো খারাপ লাগেনি, হাত-পা কাঁপা তো দুরের কথা । কিন্তু আজকাল এমন কেনো হয়? সে তো কারো প্রেমে পড়েনি। স্বপ্নও ভাঙেনি। তাছাড়া মন খারাপ হওয়ার তেমন কোনো বড় কারণও খুঁজে পাচ্ছে না মুরাদ।
ঘরে প্রবেশ করেই ফ্রিজের ঠান্ডা পানি খেলো দু’গ্লাশ। তারপর ওয়াশরুমে গেলো মুরাদ। ওজু করলো, এসি আর ফ্যান ছেড়ে চোখ বন্ধ করে জায়নামাজে বসলো মুরাদ। ঝাড়া দশমিনিট চোখ বন্ধ করে আল্লাহ আল্লাহ ডাকতে লাগলো। কিছুটা সুস্থ বোধ করলো ও। তারপর বিছনায় শুয়ে পড়লো। চোখ বন্ধ করলো ও। ঠিক কি কারণে এমন হচ্ছে? যার মন রয়েছে তার মন খারাপ হতেই পারে। কিন্তু খারাপ হওয়ার কারণ খুঁজে পায় না মুরাদ। তাই হয়তো ব্যাপারটা অযথা মনে হচ্ছে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে তাকে অবশ্যই পাগলা গারদে ভর্তি হতে হবে। যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে সঠিক কারণ। আর যাই হোক, মরে যাওয়ার ইচ্ছাটা খুব বাজে। তাছাড়া পরকালে শাস্তি তো পেতেই হবে।
নাহ... আজ খুঁজে বের করতেই হবে। খুব ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করলো মুরাদ। কুলকিনারা পেলো না। মাথা বনবন করে ঘুরতেই লাগলো, সেই সাথে বমির উদ্রেগ। মুরাদ পষ্ট বুঝতে পারলো, এই ব্যাপারটা ঘটছে দু’মাস ধরে। আগে এমন হত না। মুক্তার বিয়ে হওয়ার খবর শুনেও না। আজ সারাদিন কীভাবে কাটিয়েছে ভাবতে চেষ্টা করলো মুরাদ। খুঁজে পেলো না যুঁতসই কোনো কারণ। তবে পথে এক পা ভাঙা একটা শীর্ণকায় কুকুর দেখেছে। নিশ্চই খেতে পায়নি কয়েকদিন। বুকটা কেমন মোঁচড় দিয়ে ওঠলো । সাথে সাথেই দোকান থেকে একটা বনরুটি কিনে কুকুরকে দিলো মুরাদ। কুকুরটাকে খাওয়াতে পেরে কিছুটা ভালো লাগলো ওর। তবুও পুরোপুরি মন ভালো হলো না। তবে মাথাব্যাথাটা কমেছে কিছু। মাঝে-মাঝে ভাবে, যখন অনেক টাকা হবে তখন একটা আশ্রম প্রতিষ্ঠা করবে ও। নি:স্বার্থ উপকার করবে মানুষের। যদিও মানুষ উপকারের প্রতিদান ক্ষতির মাধ্যমেই শোধ করে। সবচে বড় কথা সে কারো প্রতিদান আশা করে না। তারচে মানুষের বদলে পশু-পাখি হবে ওর বন্ধু। ওদের সাথেই সময় কাটাবে। তবে কি কুকুরের কারণেই তার মন খারাপ? হয়তো বা।
মা এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কি হয়েছে। এমনিতেই মাথা ঘুরাচ্ছে, বলেছিলো মুরাদ। মা অবশ্য কিছুক্ষণ গাইগুই করে মন খারাপের কারণ জানতে চেয়েছেন। তার কোনো পছন্দের মেয়ে আছে কিনা, মেয়ের কারণেই কী মন খারাপ নাকি অন্যকোনো সমস্যা? ইত্যাদি জানতে চেয়েছেন। কিন্তু মুরাদ তো প্রেম করে না। তাছাড়া মন খারাপের সঠিক কারণও নির্ণয় করা যাচ্ছে না, সুতরাং মাকে কি বলবে ও? তারপরও মাকে বলেছে সে... যদি কখনো পছন্দ হয় কাউকে তাহলে জানাবে। তারপর মা খেতে ডেকেছেন। বাইরে খেয়ে এসেছে, তাই খেতে যায়নি।
চোখ বন্ধ করে আবার ভাবতে চেষ্টা করলো ও কেন তার মরে যেতে ইচ্ছা করে? উত্তর খুঁজে পায় না ও। সাধারণ একটা কুকুরের জন্য মন এতবেশি খারাপ হবে? নাহ...। তবে কি সে পাগল হয়ে যাচ্ছে? এখনি কি মনোবিজ্ঞানী দেখানো দরকার? বুঝতে পারে না মুরাদ। শুধু এতটুকু বুঝতে পারে, ওর মরে যেতে ইচ্ছা করছে। খুব বাজে ব্যাপারটার প্রতিই তার এতো আগ্রহ কেন? অকারণেই চোখ বেয়ে পানি পড়ে মুরাদের। আজ কেনো যেনো তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।
🤐
ReplyDelete