বান

  -তারিক ওয়ালি

১.
সকাল থেকে ধান কাঁটছে রহমতুল্লাহ। ছেলে সিদ্দীক ও অবিশ্রান্ত খাঁটছে বাপের সাথে। কিছুক্ষণ কাঁটার পর জিরোতে বসেছে রহমতুল্লাহ। শরীরে কুলায় না। হাঁপরের মতো উঠানামা করছে বুক। ছেলের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। সিদ্দীক আছে বলেই রক্ষা। সবে সংসারের হাল ধরতে শিখেছে। খাঁটছে সকাল থেকে। একটুও জিরোয়নি। যেন ক্লান্তি নেই কোনো। মনে মনে আল্লাহ কে ধন্যবাদ জানায় রহমতুল্লাহ। আর পাঁচ সাতটা ছেলের মতো হয়নি। জুয়া-আড্ডাতে যায় না কখনো। শৈশবের কথা মনে পরে। কি পরিশ্রমই না করতো তখন। গায়ে জোর ও ছিলো অশুরের মতো। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কোথায় সেই শক্তি। ছেলের দিকে তাকায়। এখনো ধান কাঁটছে সে। একজন লোক রাখবে সে ক্ষমতাও নেই। ৩০০ টাকা রোজ। ধান কাঁটা থেকে শুরু করে মাড়াই করা, সেদ্ধ, রোদে শুকানো সব নিজেরাই করতে হয়, না হলে পোষায় না। রহমতুল্লাহ ডাক দেয়- সিদ্দীক!
- কি বাজান?
- আয় ভাত খাইয়া যা, কতক্ষণ বাদে কাজ করিছ।
গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে সিদ্দীক আইও খাইয়া লই।
ভাত খেতে বসে দুজনে। হিঁদল শুটকির ভর্তা আর পান্তাভাত, যেন অমৃত।
২.
খাওয়া শেষ করে ছেলেকে বলে রহমতুল্লাহ- অট্টু জিরাইয়া আডিগুলা বাইত থুইয়া আইয়া পড়িছ। খবর বেশি ভালা না। মাস্টর সাবে কইল সুনামগঞ্জ না কি গঞ্জ জানি, হেদিকের সব ধান তলাইয়া গেছে। পানি নাকি আমগো এদিক ও আইতাছে।
সমূহ ক্ষতির আশংকায় বুক কেঁপে উঠে সিদ্দীকের।
-কও কি বাজান! কোনবালা হুনছো?
-আজগা সকালে হাডে গেছিলাম না দুধ বেছতে?
আর কিছু জানতে চায় না সিদ্দীক। রহমতুল্লাহ আঁটিগুলো বেধেঁ দেয় বাঁশের দুমাথায়। বাঁশ কাঁধে নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটে সিদ্দীক। বলে আমি অক্ষনি আইতাছি।
মনে নানা দুঃচিন্তা সিদ্দীকের। যদি তলিয়ে যায়। বছর পাঁচেক আগে এমন হয়েছিলো। কেবল ধান কাঁটা অর্ধেক হয়েছে, রাতারাতি সব ধান তলিয়ে গেলো। বাপের চোখে পানি দেখে তার অনেক খারাপ লেগেছিলো। এমনিতেই অভাবের সংসার, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘাঁ। অতীতের কষ্টের কথা ভাবতে চায় না সিদ্দীক। মনে মনে বলে আল্লা তুই আমগরে বিপদে ফালাইছ না।
৩.
শরীর ভীষণ দূর্বল লাগছে। হঠাৎ মাথা চক্কর দেয়াতে জায়গাতেই বসে পড়েছে রহমতুল্লাহ। মাথা ঝিম ঝিম করছে। সিদ্দীকের ডাকে সম্মতি ফিরে পেল সে।
-কি অইছে? তুমি এমনে বইয়া রইছো কে? শরীল খারাপ? বলতে বলতে কপালে হাত দেয় রহমতুল্লাহর। আঁৎকে উঠে সে।
- তোমার জ্বর অইছে, আমারে কিছু কইলা না কে? উত্তর দেয় না রহমতুল্লাহ। পাঁজাকোলে করে আবার বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয় সিদ্দীক। বাড়ি পৌঁছে মাকে ডাক দেয়। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে অবাক হয়ে বলে কি অইছে তর বাপের? জ্বর, তুমি মাতায় পানি দেও আমি ডাক্তর সাবেরে ডাইক্যা লইয়া আই, বলে চকিতে শুইয়ে দেয় রহমতুল্লাহ কে।
ঘন্টাখানেক পর ডাক্তার সাথে ফিরে আসে সিদ্দীক। রহমতুল্লাকে দেখে কিছু ঔষধ-পথ্যি দিলেন। বললেন ‘কোনো সমস্যা হইলে বলিস’। আমি যাই।
- কিছু খাইয়া যান ডাক্তার সাব।
- না- না, সময় নাই।
৪.
সিদ্দীক আবার ক্ষেতে ছুঁটে। যদি পানি চলে আসে কিছুই করার থাকবে না। মানুষ ও নাই, একা একাই কাজ করতে হবে আবার বাবার জন্যও দুঃচিন্তা হচ্ছে। সব ছেড়ে ছুড়ে ধান কাঁটায় মন দেয় সিদ্দীক। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই চিন্তা। যদি বাজানের কিছু হয়। ধান তলিয়ে গেলে সারা বছর চলবো কিভাবে? চাল, ডাল, তেল থাকলে চলতে কষ্ট হয় না, না থাকলে?
দ্রুত হাত চালায় সিদ্দীক। সূর্য পশ্চিমে ডুবি ডুবি করছে। লাল সূর্যটার তেজ কমে গেছে। ঠিক যেনো পতাকার লাল বৃত্ত। অসংখ্যা লাল পাহাড় পশ্চিমের আকাশে। ছোট থাকতে শুনেছিলো, ঐ লাল রং আসলে রক্ত। জাহান্নামের নদী হবে রক্তের। সেই রং মাঝে মাঝে ওঠে আসে আকাশে। এখন অবশ্য সিদ্দীক এগুলো আর বিশ্বাস করে না।
৫.
চারদিকে আলো কমে এসেছে। দূর থেকে ভেসে আসা আজানের ক্ষীণ ধ্বনি কানে বাজে সিদ্দীকের। কিছুক্ষণ পর গাঢ় অন্ধকারে ছেঁয়ে যাবে চারদিক। তখন ধান কাঁটাও সম্ভব নয়।
- কি রে? সিদ্দীক নাহি? অহন ও ধান কাঁটতাছত? বাইত যাবি না?
- অট্ট খাড়াও রমিজ কাকা, বলে সবগুলো আঁটি বাঁশের দুমাথায় দ্রুত বেঁধে কাঁধে নেয় সিদ্দীক।
- চলো কাকা।
গাঢ় অন্ধকারে ছেঁয়ে গেছে প্রকৃতি। অন্ধকার কে ভয় পায় না সিদ্দীক। কিন্তু আজ বুকটা কেমন যেনো হু হু করছে তার।
- কি রে তর বাপে কই? দেহলাম না যে?
- বাজানে বাইত, জ্বর আইছে।
- কস্ কি? কোনবালা জ্বর উডছে?
- আজকা ই।
ততক্ষণে তারা বাড়ির কাছে এসে পৌঁছুছে।
- ল, তর বাপেরে দেইখ্যা যাই।
- আ ও কাকা।
৬.
চকিতে শুয়ে আছে রহমতুল্লাহ। ঔষধ খাওয়ার পর জ্বর ছেড়েছে। কিন্তু এক্ষণে মারাত্মক মাথা ব্যাথা করছে।
মা! রমিজ চাচা আইছে, বলতে বলতে ঘরে ঢুকে সিদ্দীক। পেছনে রমিজ মিয়া। ঘোমটা ঠিক ঠাক করে একটা জলচকি দিয়ে বলল তর কাকারে বইতে দে।
- না না, আমি বমু না, বলে কপালে হাত দেয় রহমতুল্লার। চোখ মেলে তাকায় রহমতুল্লা। আবার বন্ধ করে ফেলে।
- মাথাডা বেদনা করতাছে? জিজ্ঞেস করে রমিজ মিয়া।
মৃদু মাথা নাড়ায় রহমতুল্লাহ।
হুঁ, বাতাশ বেশি ভালা না। ঠিকমতো অষুদ খাইও ভাইছাব। যাই ভাবী বলে ঘর থেকে বের হয় রমিজ মিয়া। সিদ্দীক! ডাক দিয়ে ঘুরে দাড়ায়।
- কি চাচা?
- তর বাপেরে ঠিক মতোন দেহা শোনা করিছ।
৭.
হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসেছে সিদ্দীক। রহমতুল্লাহ ও বসেছে। রুচি নেই একটু ও । কেমন বিস্বাদ আর বমি বমি লাগছে। জোর করে খাওয়ার চেষ্টা করলো কয়েক লোকমা।
- আর কয়ডা জোর কইরা খাও, নাইলে অষুধ খাইবা কেমনে? বলে রহিমা।
- না, বুমি বুমি লাগদাছে, অষুদ দেও। ঔষধ খেয়েই শুয়ে পড়ে রহমতুল্লাহ।
৮.
গভীর রাত। জ্বর আবার এসেছে রহমতুল্লাহর। চোখ দুটি জ্বালা করছে। স্পষ্টভাবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, সব গাঢ় হলুদ। হঠাৎ পেট মোচড় দিয়ে উঠল। হড়হড়িয়ে সব পেট থেকে বের হয়ে গেলো। নাঁড়িভূড়ি সব বেরিয়ে আসতে চাইছে। সারা ঘর যেনো দুলছে। জেগে উঠে রহিমা। দূর্ভাবনায় ঘুমুতে পারেনি এতোক্ষণ। মাত্র চোখটা লেগেছিলো। পানি আর পিকদানি এনে দেয় কুলি করার জন্য। শরীরে হাত দিয়ে আঁতকে উঠে, তাপে পুরে যাচ্ছে সারা শরীর। রুটি সেঁকা যাবে অনায়েসে।
সিদ্দীক! সিদ্দীক!! ডাক শুনে ধড়মড়িয়ে ওঠে সিদ্দীক।
- কি গো মা? কি অইছে? বলে দৌড়ে আসে পাশের কামড়া থেকে।
- জ্বর আবার উডছে তর বাজানের, বুমি করছে।
- আমি পানি আনতাছি, মাথায় পানি দিতে অইবো, বলে বালতি নিয়ে বেরোয় সিদ্দীক।
৯.
অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢালছে রহিমা, জ্বর কমছে না মোটেই। সিদ্দীক হাতে-পায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছে। হঠাৎ হাঁক শোনা গেলো, রহমতুল্লাহ! ও..ও.. রহমতুল্লাহ! বাড়ি আছো?
সিদ্দীক ওঠে দরজা খোলে। কেডা ও? ও.. সালাম কাকা! তুমি এই রাইতে?
- তাত্তাড়ি কাঁচি লইয়্যা আয়। ধান তলাইয়্যা যাইতাছে।
- কও কি! হাঁছা?
- হাঁছা না মিছা গিয়া দেখ। হাডু হমান তলাইয়া গেছে, বলে দৌড়ে চলে যায় সালাম মিয়া। সালাম মিয়া আর সিদ্দীকদের জমি পাশাপাশি। সালাম মিয়াদের ধান কাঁটা প্রায় শেষ, কিছু বাকি আছে। কিন্তু সিদ্দীকদের? অর্ধেকের বেশি বাকি। হতাশায় সব অন্ধকার দেখছে সিদ্দীক। ‘আল্লা এইডা কোন বিপদ দিলি?’ মন হু হু করে উঠে তার। কাঁচি নিয়ে ছুটে ক্ষেতের দিকে।
১০.
চোখ মেলে রহমতুল্লাহ। পাকা আমের মতো লাল হয়ে গেছে চোখ দুটি। সিদ্দীক কই গেছে রহিমা? উত্তর না পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে রহমতুল্লা। মুচকি হাসে সে। কান্নার চেয়ে বড় করুণ সে হাসি। বিড় বিড় করে রহমতুল্লাহ, মাস্টর সাবে ঠিকই কইছিলো। পানি আইয়া পড়বো, কিন্তু এত তাত্তাড়ি পানি কি এমনেই আইয়া পড়ে? এক দেশ আরেক দেশের ক্ষতি করে, মানুষ মানুষের ক্ষতি করে। হায়রে দুনিয়া।
স্বামীর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রহিমা। কিছুই বুঝতে পারে না সে।

Comments

Popular posts from this blog

ভালোবাসি

নদী

স্বাধীনতা